নিউমোনিয়া কি?
নিউমোনিয়া একটি গুরুতর রোগ যা শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ যা ফুসফুসের মধ্যে প্রদাহ সৃষ্টি করে। এই রোগ সংগঠিত হয় আমাদের ফুসফুসের আলভিওলি বা ছোট ছোট বায়ু থলিতে জীবাণুর সংক্রমণের ফলে। এটি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক দ্বারা সৃষ্ট হতে পারে। নিউমোনিয়ার নানা প্রকারভেদও রয়েছে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার তেমন নির্দিষ্ট কোনও বয়স নেই। সাধারণত গুরুতরভাবে অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল ব্যক্তিদের জন্য।
সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় লক্ষাধিক মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন। বিশেষ করে শীতকালে শিশু এবং বয়স্কদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায় আমাদের দেশে। নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যু হার প্রায় 14 থেকে 30%। তাই এই রোগ সম্মন্ধে সর্বদা আমাদের সতর্ক থাকতে হবে এবং জানতে হবে কি ভাবে এই রোগ থেকে বিরত থাকা যায়, প্রতিরোধ করা যায় এবং দ্রুত প্রতিকার পাওয়া যায়।
নিউমোনিয়া কি ছোঁয়াচে ?
নিউমোনিয়া সাধারণত সরাসরি ছোঁয়াচে নয়। চিকিৎসকদের মতে, ‘‘আক্রান্ত রোগীকে স্পর্শ করলে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা একেবারেই নেই। তাই, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ রোধে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা এবং সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। তবে, নিউমোনিয়ায় সংগঠিত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সহজেই এক ব্যক্তির থেকে আরেক ব্যক্তির মধ্যে ছড়াতে পারে। বিশেষ করে রোগীর কাশি বা হাঁচি থেকে এই রোগের জীবাণু ছড়াতে পারে। একে ‘ড্রপলেট ইনফেকশন’ বলা হয়।
নিউমোনিয়ার লক্ষণ
নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলি অনেক গুলো কারণের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে কিংবা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে এবং সেগুলি হালকা থেকে গুরুতর পর্যন্ত হতে পারে। বিভিন্ন বয়স অনুযায়ী লক্ষণ প্রদর্শন করতে পারে। এখানে কারণ এবং নির্দিষ্ট বয়সের উপর ভিত্তি করে লক্ষণগুলি দেয়া হয়েছে যেই লক্ষণগুলি সংক্রমণের পরে ধীরে ধীরে শরীরে প্রকাশ পেতে পারে:
বয়স্কদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণঃ
বড়দের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলো শিশুদের থেকে কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। এদের মধ্যে রয়েছে:
- উচ্চ জ্বর এবং ঠান্ডা লাগা
- প্রচণ্ড কাশি, কখনও কখনও কফের সাথে রক্ত দেখা যেতে পারে
- শ্বাস প্রশ্বাসে কষ্ট
- শ্বাস নেওয়া বা কাশির সময় বুকে ব্যাথার অনুভূতি
- শ্বাস নেওয়ার সময় বুকের ভেতরে ঘরঘর আওয়াজ
- শরীরে উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর আসা (103 F বা 39.4 C)
- বুকে ব্যথা অনুভব করা
- সারা শরীরে ব্যথা অনুভূত
- খাবারের অরুচি
- টানা 3 সপ্তাহের বেশি কাশি হওয়া
- কাশির সঙ্গে রক্তপাত
- ফ্যাকাসে নীল শিরার দাগ দেখা যাওয়া
- অত্যধিক ক্লান্তি এবং দুর্বলতা
- মানসিক বিভ্রান্তি
বয়স্কদের নিউমোনিয়া হলে করনীয়
বয়স্কদের নিউমোনিয়া হলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে করণীয় কিছু পদক্ষেপ:
চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা
প্রচুর বিশ্রাম নেওয়া
পর্যাপ্ত পানি পান করা
নির্ধারিত ওষুধ সঠিকভাবে গ্রহণ করা
পুষ্টিকর খাবার খাওয়া
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণঃ
- শ্বাসকষ্ট
- শীর্ণতা
- প্রস্রাব কমে যাওয়া
- ত্বক ফ্যাকাশে হওয়া
- কান্না বেড়ে যাওয়া
- খাওয়ানোর অসুবিধা
- ক্ষুধামান্দ্য
শিশুদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া নিরাময়ের উপায়
2 মাসের কম বয়সী শিশুদের জন্য নিউমোনিয়া মারাত্মক ব্যাধি হিসেবে আকার ধারণ করতে পারে। এই রকম ক্ষেত্রে নিউমোনিয়ার উপসর্গ দেখা দিলে রোগী কে দ্রুত হসপিটালে ভর্তি করা দরকার। এছাড়া ও সাধারণ কিছু বিষয় অনুসরণ করতে হবে –
- শিশুদের সময় মতো নিউমোক্ককাস, হাম এবং হুপিং কাশি (পারটুসিস) টিকা দিতে হবে।
- জীবনের প্রথম 6 মাস বুকের দুধ খাখাওয়াতে হবে। এতে শিশুদের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পায়।
- নিউমোনিয়া ধরা পরলে স্যুপ জাতীয় পানীয় খাবার খাওয়াতে হবে। এতে শরীরের পানির ঘাটতির অভাব হবে না।
- কাশির ওষুধ সম্পর্কে ডাক্তারদেরসাথে পরামর্শ করুন।
- সঠিক সময়ে শিশুকে খাবার আর ওষুধ খাওয়ান।
- লবণাক্ত গরম জলের ভেপার নেওয়া যেতে পারে।
নিউমোনিয়া প্রতিকার
নিউমোনিয়ার চিকিৎসার জন্য প্রাথমিকভাবে লক্ষণগুলোর উপশম এবং সংক্রমণের মূল কারণ নির্ণয় করা হয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে:
- ধুমপান বন্ধ করা
- পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস
- ধোঁয়া ও ধুলো এড়িয়ে চলা
- প্রাপ্ত বয়স্ক এবং শিশুদের ফ্লু ভ্যাক্সিন দেওয়া
- নিউমোনিয়া হলে নাক ও মুখ মাস্কে ঢেকে রাখা
- বিশ্রাম এবং প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা
- শ্বাসতন্ত্রের ব্যায়াম এবং বাষ্প গ্রহণ
- নির্ধারিত এন্টিবায়োটিক ওষুধ গ্রহণ
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অন্যান্য ওষুধ গ্রহণ করা
নিউমোনিয়া রোগীর খাবার
নিউমোনিয়া রোগীদের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছু সুপারিশকৃত খাবার:
- প্রচুর পরিমাণে তরল, যেমন পানি, স্যুপ, ফলের রস
- প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার, যেমন মুরগি, মাছ, ডাল
- ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল, যেমন কমলা, লেবু
- টক দই জাতীয় প্রোবায়োটিক খাবার।
- শাকসবজি এবং ফলমূল
- পনির, ডাল, লেবুর মত খাবার।
- গরম দুধ
নিউমোনিয়ার এন্টিবায়োটিক
নিউমোনিয়া যদি ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়, তাহলে এন্টিবায়োটিক ওষুধ প্রয়োজন হতে পারে। সাধারণত ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিকগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- অ্যামোক্সিসিলিন
- আজিথ্রোমাইসিন
- ক্লারিথ্রোমাইসিন
চিকিৎসক নির্ধারিত মাত্রা অনুযায়ী এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করতে হবে এবং সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করতে হবে।
নিউমোনিয়া রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধ
নিউমোনিয়া প্রতিরোধের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
- নিয়মিত হাত ধোয়া
- শীতের মৌসুমে গরম পোশাক পরা
- সঠিক পুষ্টিকর খাবার খাওয়া
- ধূমপান এবং দূষিত পরিবেশ এড়ানো
- ফ্লু এবং নিউমোনিয়া ভ্যাকসিন গ্রহণ
নিউমোনিয়া একটি গুরুতর রোগ, তবে সঠিক যত্ন ও চিকিৎসার মাধ্যমে এটি থেকে সুস্থ হওয়া সম্ভব। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে নিউমোনিয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।